স্বনির্ভরতা অর্জন: কিছু কথা কিছু করণীয়
বাবুল চন্দ্র সূত্রধর, মানবাধিকারকর্মী ও গবেষক: সাধারণত সমাজে মানুষের চাহিদা ও চাহিদা পূরণের উপাদানসমূহের অপ্রতৃলতা থেকে বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য সৃষ্টিলাভ করে বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু বৈষম্য সৃষ্টির পেছনে এটি একটি সুকৌশল ও পরিকল্পিত যুক্তি মাত্র। যদি সমাজের কেউই প্রয়োজনীয় সামগ্রী লাভে সক্ষম না হয় তবে ভিন্ন কথা; আর যদি কেউ পায় কেউ পায় না তাহলে তো কথা থেকেই যায়। বস্তুত পৃথিবীর বৈষম্যমূলক সমাজসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এর পেছনে আসল ভূমিকা পালন করে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের লোভ-লালসা ও অন্যকে ঠকিয়ে নিজের/ নিজেদের উদর পূর্ণ করার আগ্রাসী মানসিকতা। সামাজিক স্তরবিন্যাসের উচ্চস্তরে অবস্থানকারী ও এদের আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমেই এ প্রক্রিয়া চলমান থাকে। এর সাথে যদি স্বার্থবাদী মতলববাজদের ব্যবস্থাপত্র যুক্ত হতে পারে (যা অনেক ক্ষেত্রে ঘটে থাকে), তাহলে তো মণিকাঞ্চন যোগ। তথাপি মানুষ বসে নেই, স্বভাবের তাড়নায় সে এগিয়ে যেতে চায়।
পদ্ধতি, প্রক্রিয়া, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রভৃতিতে নানা ধরনের প্রভেদ বিদ্যমান থাকলেও বিশ্বের সকল সমাজেই উন্নয়নের জোর কর্মপ্রবাহ পরিলক্ষিত হয়। আদি থেকে বর্তমান- মানুষ সর্বদাই ব্যক্তিগতভাবে ও দলগতভাবে আপন অবস্থান পরিবর্তন করে সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টায় মনোযোগী থেকেছে। তবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মানুষের এহেন প্রচেষ্টা সর্বদা কণ্টকমুক্ত ছিল না; নানা রকমের বাধা এসে মানুষের সামনে হাজির হয়েছে। এসব বাধার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, ‘পরধন লোভে মত্ত’ নির্লজ্জ স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি-গোষ্ঠীর কবলে পড়ে অপরাপর ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বাধীন স্বত্তার অকার্যকারিতা; বর্ণগত, লিঙ্গগত, অঞ্চলগত ও উপগোষ্ঠীগত সাম্প্রদায়িকতা; মৌলবাদী ধ্যান-ধারণাপ্রসূত আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ; উৎপাদনযন্ত্রের মালিকানা ও অমালিকানাভিত্তিক শোষণ প্রভৃতি। বর্তমানে দৃশ্যত এসব অভিসন্ধিমূলক চেতনা অনেকাংশে দৃশ্যমান নেই, কিন্তু সময়ে সময়ে এগুলো প্রেতাত্মার মত নানা রূপ ধারণ করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তাও আমরা প্রত্যক্ষ করি। শুধু তাই নয়, এক দল মানুষের কর্মপ্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করার লক্ষে আর এক দল মানুষের মাধ্যমে নানামুখী অপতৎপরতার ফন্দি-ফিকির এখনও আবিস্কৃত হয়ে চলেছে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আইনের উপস্থিতিও প্রচুর। কিন্তু যেহেতু বিষয়টি মূলগতভাবে মনস্তাত্ত্বিক, তাই আইনের ব্যবহার বা প্রয়োগ মানুষকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা প্রদান করতে পারে না- এর জাজ্জ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হিসেবে বাংলাদেশের নানা ক্ষেত্রে আইনের প্রণয়ন, প্রয়োগ ও ফলাফলের কথা উল্লেখ করা যায়। উল্লেখ করা যায় স্বঘোষিত বিশ্বনেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথাও। শুধু তাই নয়, হাতে গোনা কয়েকটি দেশ ব্যতীত বিশ্বের সকল দেশই এই তালিকায় আসার মত অবস্থায় রয়েছে। বর্বরযুগের কথা না হয় বাদই দিলাম, আধুনিক সভ্য জগতেও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী আক্রমণের শিকার হচ্ছে, প্রাণভয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে দেশ-দেশান্তরে; জানমালের নিরাপত্তাহীনতায় ধুকে ধুকে মরছে কত জনগোষ্ঠীর মানুষ; নাম না জানা কতজন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে সম্পদ ও সম্ভ্রম রক্ষার তাগিদে; কত জন কত অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে চলেছে- কথা বলার বা প্রতিবাদ করার সুযোগ পর্যন্ত পাচ্ছে না।
তবে একইসাথে বিবেকের প্রয়াসও ক্রিয়াশীল রয়েছে। সাম্প্রতিক কালের বেশ কয়েক দশক ধরে দেশে দেশে স্বনির্ভরতা আন্দোলন বা আত্ম-উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার নানাবিধ উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়। এহেন উদ্যোগ থেকে অবশ্য বিভিন্ন জাতি বেশ সুফল পেয়েছে, অনেকে আসলেই নিজের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে শক্তভাবে, অন্যান্য অনেকের জন্য অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে কেউ কেউ। আমাদের এশিয়া মহাদেশের কিছু দেশ এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যারা এক সময় নিজেদেরকে রক্ষা করার উপায় অনুসন্ধানের জন্য অন্যের দ্বারে ঠক ঠক করেছে, তারা আজ নানা ক্ষেত্রে রীতিমত দাতার আসনে বসেছে, যারা দরিদ্র বলে পরিচিত তাদেরকে দেখভাল করে যাচ্ছে যথাসাধ্য।
তবে এর একটি ভয়াবহ অথচ উজ্জীবনাময় পটভূমি রয়েছে। তা হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ বিশ্বযুদ্ধের সীমাহীন রক্তপাত বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মানসলোককে গভীরভাবে আলোড়িত ও আন্দোলিত করে। ঠিক যেন অশোকের মত; সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের রক্তস্নাত ও শোচনীয় পরিণাম পরিদৃষ্ট হয়ে জীবনে আর যুদ্ধ করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যা হোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ভয়াবহতা দুটি বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে:
১. বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্টা লাভ করে এবং জাতিসঙ্ঘেরই প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্রের সমর্থনসূচক স্বাক্ষর প্রদানের মধ্য দিয়ে ‘মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র’ আত্মপ্রকাশ করে, যা সদস্য রাষ্ট্র বা জাতিসমূহকে আত্মসমীক্ষা ও দায়বদ্ধতার আওতায় নিয়ে আসে।
২. যুদ্ধ নয় শান্তি- এই মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো স্ব স্ব জাতীয় উন্নয়নে গভীরভাবে মনোনিবেশ করে, যাতে স্বনির্ভরতার বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারে। প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল এশিয়ার দেশ জাপানের মাধ্যমে; আর, জাপানের প্রেরণাদাতা ছিলেন বাংলার কৃতী সন্তান আইনবিদ ড. রাধাবিনোদ পাল।
এই দ্বিবিধ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে গোটা বিশ্বে শুরু হয় নবতর চিন্তা-ভাবনা। প্রথমোক্তটিতে অধিক মনোযোগ প্রদান করে সেসব রাষ্ট্র, যারা সমরশক্তি, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ততটা মজবুত ছিল না। আর, দ্বিতীয়োক্তটিতে অধিক মনোযোগ প্রদান করে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো, কেননা যুদ্ধে সার্বিক ক্ষতির হিসেব কষলে এর সিংহভাগ তাদের দিকেই যায়। অধিকন্ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলস্বরূপ সুদীর্ঘকাল থেকে চলে আসা উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ধারা অনেকটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ায় সমরবাজ রাষ্ট্রগুলো তাদের ভবিষ্যত আর্থ-রাজনৈতিক শক্তিমত্তার ধারাবাহিকতা নিয়ে প্রবল চাপ অনুভব করতে থাকে। এতদিন অনগ্রসর জাতি বা রাষ্ট্রগুলোকে শোষণের ফলে বিনা পুঁজিতে যে উপার্জন হত, সে পথ অনেকটা রুদ্ধ হয়ে পড়ে। শুরু হয় স্বকীয় সম্পদ বা উপাদান এবং যুক্তি-বুদ্ধি খাটিয়ে কিভাবে জাতীয় উন্নয়নের ধারাকে গতিশীল রাখা যায়, এমন এক অভূতপূর্ব ও আধুনিক চিন্তাচেতনা। একই কারণে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জাতিগুলোতে আসে উন্নয়নের এক বিপুল প্রেরণা। জাতীয়তাবোধ ও স্বকীয় প্রশাসনের আওতায় জনমনে সৃষ্টি হয় নবতর আশা-আকাঙ্খা। পুঁজিবাদী সমাজতন্ত্রী সর্বত্রই জাতীয় উন্নয়নের বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়।
স্বনির্ভরতা, আত্মনির্ভরতা, স্বয়ংসম্পূর্ণতা, স্বাবলম্বন, স্বয়ম্ভরতা প্রভৃতি পদ আভিধানিকভাবে সমার্থবোধক হলেও এগুলোর ব্যবহারিক কিছুটা তারতম্য রয়েছে। এই পদসমষ্টির মধ্যে স্বনির্ভরতার (বা আত্মনির্ভরতা) অর্থই গভীরতর; অধ্যাপক মো: আনিসুর রহমান মনে করেন, স্বনির্ভরতা হলো মানসিক ও পার্থিব স্থিতিশক্তির এমন এক মিশ্রণ, যার দ্বারা বহি:শক্তির কর্তৃত্বকে প্রতিহত করা যায়, এটি নিছক স্বয়ংসম্পূর্ণতা নয়। তিনি চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন যে, স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সনে দেশে যখন দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, তখন সবচেয়ে দু:স্থ এলাকা রংপুরের কিছু জনগোষ্ঠী আমেরিকা থেকে আসা ত্রাণসামগ্রী গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে সংঘটিত নির্মম রক্তপাতকে আমেরিকা সমর্থন করেছিল, তাই আত্মসম্মানে বলীয়ান এই লোকজন এহেন সাহায্যকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাই বলা যায়, স্বনির্ভরতা হলো একটি সামগ্রিক প্রত্যয় যেখানে বাকী পদগুলো অর্থনীতির গণ্ডীতে আটকা পড়ে গেছে। মোদ্দা কথা, স্বনির্ভরতার উপস্থিতি যেখানে রয়েছে, সেখানে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা জাতি জীবনাচরণের সকল দিক থেকে স্বাধীনতা উপভোগ করে থাকে, শুধু পেটে অন্ন যোগানোর ক্ষমতাকেই স্বনির্ভরতা বলে চালানো যায় না। ‘প্রয়োজনের রাজ্য থেকে যখন স্বাধীনতার রাজ্যে মানুষের উত্তরণ ঘটবে’, সমাজ-চিন্তক ফ্রেডারিক এঙ্গেলস-কথিত এই পরিস্থিতিতেই কেবল স্বনির্ভরতার আগমন নিশ্চিত হতে পারে। স্বনির্ভরতা প্রত্যয়টির সাথে বেশ কিছু নিয়ামক যুক্ত রয়েছে; প্রধান ক’টি হল:
- আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য তথা সামাজিক গতিশীলতার মুক্ত অবস্থার উপস্থিতি
- সামাজিক নিরাপত্তা তথা মত প্রকাশ, চলাফেরা, নিরাপদ বসবাসের নিশ্চয়তা
- আদর্শিক পছন্দ তথা রাজনীতি ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ক্ষেত্রে স্বাধীনতার উপস্থিতি
- সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা তথা জীবনধারণের নানা উপাদানের নির্বিঘ্ন চর্চার ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা
- ধর্মীয় স্বাধীনতা তথা নানাবিধ আচার-আচরণের নির্বিঘ্ন চর্চার ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা
- শিক্ষা ও কর্মমুখী প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের অবাধ পরিবেশের নিশ্চয়তা
- সর্বোপরি, সকল মানুষের সকল ধরনের অধিকারকে সর্বাগ্রে বিবেচনা করার মৌলিক ধারণা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে ছড়িয়ে দেওয়ার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা ও নিয়মিত পরিবীক্ষণের প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি বিধিবদ্ধ করা।
প্রসঙ্গত বলা আবশ্যক যে, স্বনির্ভরতা প্রত্যয়টিকে অনেকে সেকেলে বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করে এ নিয়ে আলোচনায় অনাগ্রহী হয়েছেন। কিন্তু যেসব পরিস্থিতি আমরা এখনো লক্ষ্য করে থাকি, সেসব কি স্বনির্ভরতার অনুপস্থিতিরই সাক্ষাৎ প্রমাণ নয়? অধিকার প্রত্যয়টির ব্যানারে কি আমরা একই বিষয়ের কথা বলছি না? মোদ্দা কথা, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী প্রাত্যহিক জীবনাচরণে যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যখন অন্যের নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকার মত পরিবেশে বসবাস করে, তখনই স্বনির্ভরতার বিলোপেরই প্রকাশ ঘটে।
মানবাধিকার, উন্নয়ন, স্বাধীনতা, শান্তি, সংহতি প্রত্যয়গুলোর মত স্বনির্ভরতা নিয়তই পারস্পরিক, ব্যক্তিগত নয়। তাই আন্ত;ব্যক্তি, আন্ত;গোষ্ঠী, আন্ত:জাতি ইত্যাকার প্রত্যয় গভীরভাবে অনুধাবন করা এক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরী। তবে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক যাই হোক, উদ্দেশ্যে উপনীত হওয়ার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটি সার্বজনীন মনো-সামাজিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করা, যেখানে মানবকুলের সকল সদস্যের একটি অভিন্ন পরিচয় বিধিবদ্ধ থাকবে, যা মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রে সন্নিবেশিত হয়েছে। আমরা চাই, স্বনির্ভরতায় সুসমৃদ্ধ একটি যুক্তিশীল বিশ্বব্যবস্থা, যেখানে মানুষ মাত্রেই মানবতার সকল উপাদান নিয়ে জীবনচর্যা পরিচালনা করতে পারবে।
আপনার মতামত লিখুন